বাস্তব ঘটনা তা না। ঢাকা শহরের মতো ঘন জনবসতি আর দালানে-পিলারে-সাইনবোর্ডে-ইলেকট্রিক তারে ঘিঞ্জি একটা জায়াগায় ভূমিকম্পের সময় বাইরে বের হওয়া মানে মোটামুটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া।

আজকের নেপালের ছবিগুলো দেখুন, রাস্তার দুপাশে বিল্ডিংয়ের কাঠামোগুলো খা খা করে দাঁড়িয়ে আছে; শুধু দেয়ালগুলো ভেঙে গিয়ে সব ইট, কাঠ, কংক্রিট স্লাব আর কাঁচের টুকরো রাস্তায় স্তুপ হয়ে আছে। কিছু বিল্ডিং হেলে গেছে, ওগুলোর থেকে ভেঙে পড়া ইটপাথরও আশপাশের রাস্তায় জমেছে। ওগুলো সব পড়ার সময় উঁচু দালান থেকে ছিটকে পড়েছে, অনেকটা পাঁচতালার ছাদ থেকে বিশ কেজি পাথর ফেলে দিলে যেমন হবে তেমন। এক্ষেত্রে শুধু ফারাকটা হলো, একটা পাথর পড়বেনা, একের পর এক পড়তে থাকবে কিছুক্ষন ধরে। বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলেও ঘটনাগুলো পুরোপুরি এরকমই হবে।

তাই ভূমিকম্প টের পেলে সবার আগে যেটা করবেন, তা হলো, আপনার গায়ে যাতে কিছু না এসে পড়ে। চিন্তা করুন, ভূমিকম্পের সময় আপনি যে দালানটিতে আছেন, সেটা যদি ভেঙেই পড়ে, তবে তারও অনেক আগেই আপনার ফ্লোরের ওপর শোকেস, টিভি, হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট খোরা আর ঘরের অন্যান্য সব ভারী ভারী জিনিস পড়তে থাকবে। কাজেই আপনার প্রথম কাজ হলো, এসবের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা; আরো ভেঙে বললে, মাথাটাকে রক্ষা করা।

সবচেয়ে নিরাপদ হলো ডাইনিং টেবিল বা খাটের নিচে ঢুকে পড়া। একটা প্রোটেকশন নেয়া। আরেকটু পরিস্কার করে বললে, আপনার চারপাশে যেন একটা খোলামেলা ত্রিমাত্রিক স্পেস থাকে। বিল্ডিং হেলে পড়ুক আর ধ্বসে পড়ুক, এই স্পেসটা পরবর্তিতে আপনার উদ্ধার হবার সম্ভাবনাকে অনেকগুন বাড়িয়ে দেবে।

আরো কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন।
১. ভূমিকম্প হলে সবাই মিলে কোথায় ঢুকবেন সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। বড় ডাইনিং টেবিল থাকলে সেটার নিচেই সবচেয়ে ভালো। উঁচু খাট থাকলে সেটাও খুব ভালো, বিশেষ করে ম্যাট্রেস (চাপ শোষন করবে) আর শক্ত পাটাতন থাকলে তো কথাই নেই।

২. আর লাগবে ভূমিকম্প সারভাইবাল কিট — মিনিমাম, একটা টর্চ লাইট, দুই পাউন্ড টোস্ট বিস্কিট আর এক বোতল পানি। এগুলোকে আশ্রয় নেয়ার জন্য ঠিক করা জায়গাটার ধারেকাছে কোথাও রাখুন, যাতে ভূমিকম্পের সময় আশ্রয় নিলে হাতের নাগালে থাকে।

৩. বড় ভূমিকম্প একবার হয়েই শেষ না, কয়েকদিন ধরে বারবার হয়। মাঝে মাঝে আফটারম্যাথ মুল ভূমিকম্পের চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। কাজেই একবার বড় ভূমিকম্প হলে পরের কয়েক রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছে একটা কাঁথা রাখুন, সময়মতো সবচেয়ে জরুরি মাথাটাকে ঢেকে রাখুন।

৪. ভূমিকম্পে আগুন ছড়ায়, বাংলাদেশে কাঠের বাড়ি কম বলে এটার সম্ভাবনা একসময় কম ছিলো, কিন্তু এখন যেরকম ঘিঞ্জি ইলেকট্রিক আর গ্যাসের লাইন, এক জায়গায় আগুন লাগলে দাবানল হয়ে যাবে। সবচেয়ে মারাত্নক হলো গ্যাস, এক বাসায় আগুল লাগলে, মুহুর্তে আশপাশের বাসায় গ্যাসের লাইনের মাধ্যমে সেটা ছড়িয়ে পড়বে। কাজেই প্রয়োজনের সময়টুকু ছাড়া, বাকী সময় গ্যাসের মেইন সুইচ অবশ্যই বন্ধ রাখবেন।
খ. ভূমিকম্প শেষ হলে কী করবেন?

ভূমিকম্প মানে এই না যে, জমিন নড়ে উঠলো, বাড়ী ভেঙে পড়লো, ভেঙে পড়ার আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে বেঁচে গেলাম – মামলা ডিসমিস। ঝামেলা শুরু হয় এর পরে।

একটা উদাহরণ দেই। আজকের কাঠমান্ডুতে এখন যারা বেঁচে আছেন তাদের কী অবস্থা? একটু পরপর একটা করে ভূমিকম্প আসছে, সবাই নতুন করে আতংকিত হয়ে উঠছে। ধ্বংস হয়ে গেছে এমন কিছু এলাকার ভিডিও দেখলাম টিভিতে, একটু পর পর জমিন নড়ে উঠে, আর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো হুড়মুড় করে এদিক ওদিক ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছে।

বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা হলো, এর পর সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। পানি, গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি — সব বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশে সম্ভবত আন্ডারগ্রাউন্ড পানি আর গ্যাসের পাইপগুলো ভেঙে এলোমেলো হয়ে যাবে, সাপ্লাই পুনরায় শুরু করতে কয়েক সপ্তা লেগে যেতে পারে। ইলেকট্রিক পাইপ ভেঙে, তার পেঁচিয়ে কী লংকা কান্ড বাঁধবে, কল্পনা করাও দুরূহ। ফোনলাইন বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও বিকল হবার সম্ভাবনা খুবই জোরালো।

শুধু পানি, গ্যাস, ফোন, ইলেকট্রিসিটি টাইপের লাইফলাইন না, অন্য সব কিছুও বন্ধ হয়ে যাবে। যেমন অনেক জায়াগায় রাস্তা দুভাগ হয়ে যাবে। আপনি নিরাপদ কোথাও যেতেও পারবেননা। যেহেতু আক্রান্ত এলাকায় কম্পন চলতেই থাকবে, কাজেই রাস্তার যেটুকু চলার উপযোগি থাকবে, সেটুকু ভরে যাবে গাড়িতে, রিক্সায়। সবাই সাধ্যমতো চাইবে এই এলাকা ছাড়ি। কিন্ত কতদূর?

আরো বড় যে সমস্যাটা , সেটা হলো প্যানিক। যে দোকানগুলোতে জিনিসপত্র কেনার মতো অবস্থা থাকবে, সেগুলোর কী দশা হবে ভাবুন। শতশত মানুষ ভীড় জমাবে, সবাই চাইবে যত বেশী সম্ভব এটা ওটা কিনে মজুত করি।

আরো সমস্যা আছে, এই প্যানিকের সময় গুজব ছড়াবে অসংখ্য। সেটার আফটারইফেক্ট কতদূর যাবে তা নির্ভর করবে পুরোই আপনার ভাগ্যের ওপর, মানে, গুজবটা কতটুকু ফ্যাটাল আর সেটা শুনে আপনি কতটুকু মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছেন তার ওপর।

সমস্যার শেষ নেই। বাংলাদেশ স্পেসিফিক কিছু সমস্যাও আছে। যেসব বাড়িঘর খালি রেখে মানুষ নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে যাবে, ওগুলো কতটুকু নিরাপদ থাকবে সেটাও এক প্রশ্ন। যেমন ধরা যাক, যেহেতু কারেন্ট-পানি-গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ, আপনার এলাকায় ঠিক হলো যে সবাই মিলে এলাকার প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নেবে, সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে জেনারেটর আর পানির ব্যবস্থা করা হবে। আপনারা এলাকার সবাই ওখানে গিয়ে তিনদিন থাকলেন। ফিরে এসে দেখবেন হয়তো বাড়িতে বাড়িতে চুরি হয়েছে।

এমনকি, বাংলাদেশের এখন যে অবস্থা, আপনি বাড়ী ছেড়ে কোথাও আশ্রয় না নিলেও দেখা যাবে (এমন বিপন্ন পরিস্থিতিতেও) আপনার বাড়িতে ডাকাতি করতে এসেছে একদল সোনার ছেলে।
গ. আসলে কী বলতে চাইলাম?

এটুক লেখার পর নিজের কাছেই প্রশ্ন জাগলো, আসলে কী বলতে চাইলাম? কারণ, এই সমস্যাগুলোর কী সমাধান আমার জানা নেই।

শুধু আজকের নেপালের চিত্র দেখে মনে হলো, একই রকম অবস্থার বাংলাদেশেও তো ভূমিকম্প হলে কাছাকাছি রকমের ঘটনাই ঘটবে। নেপালের আজকের ভূমিকম্পে ক্যাজুয়ালটি কয়েক হাজার হবে বলে আমার হিসেব। এর সাথে কয়েক লাখ মানুষ আগামী কয়েকদিন (কয়েক সপ্তা বা মাসও হতে পারে) ভয়ংকরতম দিন পার করবেন। সেখান থেকেও নতুন ক্যাজুয়ালটি হতে পারে।

নেপালের ক্ষেত্রে আক্রান্ত এলাকায় ঢাকার মতো ওমন উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর ঘনবসতি নেই। কাজেই ঢাকার ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের ফলে ধ্বংস ও ক্ষতির স্বরূপ নেপালের মতো হবে বলা গেলেও, সেটার স্কেল হবে আরো অনেক মারাত্নক। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, সেটার স্কেল যত বড় হবে, ভূমিকম্পের পরের ভোগান্তির বেলায় সেটার স্বরূপ আর স্কেল দুটোই হবে তত ভয়াবহ।

এসব সমস্যার কথা মাথায় রেখে আমরা যদি ভূমিকম্পের সময় কী করবো সেটা নিয়ে নিজেরা কিছু আগাম ব্যবস্থা নিয়ে রাখি। সরকার/ প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই, যা করার নিজেদেরই টুকটাক করতে হবে।
চাচা যখন হয়েছিই, প্রাণ বাঁচানোর কথাও নিজেকেই ভাবতে হবে।