স্যারের কথা সেদিন আমায় সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছিলো – কোথায় আছি আমরা আর কিভাবে বেড়ে উঠছি

টিউন বিভাগ এডুটিউনস
প্রকাশিত
জোসস করেছেন

আজ কোন টিপস নয়। আজ আপনাদের আমার জীবনের একটি গল্প শেয়ার করব। সেদিনের পর থেকে আমার মনটা বেশ খারাপ তাই ভাবলাম, ঘটনাটা লিখে ফেলি। সেদিন আমি সত্যিই ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম স্যারের কথা শুনে। কি বলব বা কি বলা উচিৎ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওর থেকে আমি এরচেয়ে বেশি কিবা আশা করতে পারি।
যাই হোক কথা না বাড়িয়ে মুল ঘটনায় চলে যাই।

আমার ভাগ্নে ঢাকার কোন এক নামিদামী কলেজের হোষ্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে। পড়াশুনার খরচ মোটামুটি ব্যয়বহুল বলা চলে। মাসে সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ২৫ হাজার টাকা কলেজে দিতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই খরচ যোগার করা বেশ কঠিনই বটে। ওদের বৈশিষ্ট হলো, বাইরে কোন প্রাইভেট পড়তে হবে না, সব সময় নজরদারী করে ভালো রেজাল্টের নিশ্চয়তা ওরা দিয়ে থাকে। নিজেরা ওদের প্রতি খেলায় রখতে পারি না বলেই হোষ্টেলে রেখে পড়াশুনা করানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো।
যাই হোক, ঢাকাতে আমার ভাগ্নের লোকাল অবিভাবক আমি, তাই কলেজ থেকে কিছুদিন আগে আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। কারন জানতে চাইলে বলেন, জরুরী কথা আছে, আসলে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। পরেরদিনই আমি সেখানে যাই। বেশকিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর প্রিন্সিপল স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি আর আমার ভাগ্নে দুজনই স্যারের রুমে ঢুকে গেলাম।

বুঝতে বাকি রইলো না স্যার আমাকে কেন ডেকেছে। ভাগ্নে আমার ক্লাশমেটদের সাথে মরামারি করেছে তাই তার বিচার শালিশি করার জন্যই আমাকে ডাকা হয়েছে। তবে মুল উদ্দেশ্য বিচার সালিশি করা বেপারটা পুরেপুরি তাও মনে হচ্ছে না।
শুরু হলো স্যারের আলোচনা, আমার সামনেই আমার ভাগ্নেকে জিজ্ঞাবাদ ও হুশিয়ারী বানি দিলো প্রায় ৩০ মিনিট। আমার ভুমিকা ছিলো, কেবল শুনে যাওয়া আর লজ্জা পাওয়া। এ ছাড়া আর কিবা করার ছিলো সেদিন। স্যারের আলোচনা শেষে ভাগ্নেকে একটা সাদা কাগজ ধরিয়ে দেয়া হলো, বললো, এখানে লিখে আনো সেদিন কি হয়েছিলো, কেন হয়েছিলো আর ভবিষ্যতে এমন কিছু করলে তোমার কি কি স্বাস্তী হওয়া উচিৎ বলে তুমি মনে করো। ভাগ্নে আমার পাশের রুমে লিখতে চলে গেলো। এবার বুঝি আমার পালা শুরু।

স্যার- খুব লজ্জা লগছে তাই না? আপনার মুখ দেখে আমারই খুব মায়া লাগছে। আপনাকে আমাদের ডাকার কোন দরকার হতো না, আমরা চাইলেই সব ম্যানেজ করতে পারতাম। কিছু আমাদের যে হাত পা বাধা। আমার একটা আলাদা রুম আছে, রুমটাতে আমার প্রায় ৫০টার মত বেত আছে। বেতগুলো ঘুন পোকায় খাচ্ছে। রুমটাও অনেকদিন খোলা হয় না। ভিতরে ময়লার স্তুপ। যাই হোক আমাদের হাত পা বাধা।

আমি বুঝে গেছে স্যার কি বলতে চাচ্ছে। মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া আমার আর কোন কিছু বলার ছিলো না। পরের কথাগুলো ছিলো আরো কঠিন।

স্যার- এক সময় আমাদের প্রতিটা ক্লাশরুমে ৫০ জন করে স্টুডেন্ট থাকত। ক্লাশরুমে কোন টু টা শব্দ পর্যন্ত হতো না। স্যার ক্লাশরুমে ঢুকলেই সব ঠান্ডা। এখন আমার প্রতি ক্লাশে ১০ থেকে ১৫ জন স্টুডেন্ট রেখেছি। অথচ তাদের সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। কথা শুনছে না, ঝাড়ি দিলে কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার শুরু করু। ইদানিং আবার মেয়েদের নতুন ফ্যাশন হয়েছে। কিছু বললেই নাকি কেদে দেয়। ভয় লাগে কখন আবার অবিভাবক ডেকে নিয়ে আসে। না জানি আবার কথন আত্নহত্না করে বসে। সব স্যারদের ইতিমধ্যে বলে দিয়েছি, একটু রয়ে সয়ে ঝাড়ি দিও যেন স্টুডেন্টরা সিনক্রিয়েট না করে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ, শিক্ষার্থী, অবিভাবক আর নিয়মতান্ত্রীক জটিলতার কাছে জিম্মি হয়ে আছে। আমরা চাইলেও ওদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। আমাদের হাত পা বাধা।

বিগত বছরগুলোতে যে কেউ চাইলেই দু একশ টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পত্র পেয়ে যেতো, সোসাল সাইটের বিভিন্ন গ্রুপে ওপেনলি এগুলো বিক্রি হয়। আর একদল প্রভাইড করে উত্তরপত্র। কিন্তু এ বছরতো প্রশ্ন পত্র ফাস হওয়ার চান্স নাই, কারন এ বছর আর প্রশ্ন ফাস করার আর দরকার নাই। পরীক্ষার আগে আমাদের কাছেও কিভাবে যেন প্রশ্ন চলে আশাকরিয়ে দিচ্ছি, আমার নিজের চাকরী আর কলেজের বিজনেসও তো ঠিক রাখতে হবে।

আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় শিক্ষাকতার পিছনেই ব্যয় করেছি। তাই আজকের এই সমাজ ব্যবস্থাকে মনে নিতে পারি না। কিন্তু কি করব, আমাদেরতো হাত পা বাধা।

আমি বুঝি যখন একজন অবিভাবককে ডেকে এনে যদি কোন অভিযোগ দিতে হয় সেটা কতবড় লজ্জার। আমি আপনার মনের অবস্থাও বুঝতে পারছি। আপনাকে ডাকার দরকার ছিলো না। মারামারি করেছে, ধরে আচ্ছা মত ধোলাই দিলেই কাল থেকে সোজা হয়ে চলতো। কিন্তু মজার ব্যপার হলো, আজ আপনার সন্তানের গায়ে হাত তুলব, কেউ একজন সেটা গোপনে ভিডিও করবে, সোসাল মিডিয়ায় পরের দিন ভাইরাল। নয়তো স্টুডেন্টরা মিলে দলবল নিয়ে আন্দোলন করতে চলে আসবে, পরের দিন আপনি আসবেন পুলিশ নিয়ে। শেষে আমাদের চাকরী নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

এখন স্টুডেন্টদের বকা পর্যন্ত দিতে ভয় পাই, কারন যদি আত্নহত্না করে বসে। আমাদের সময় ক্লাশে এমন মারামারি করলে হেড স্যার ডেকে নিয়ে জোড়া বেত দিয়ে পেটাতো, গায়ে জ্বর থাকতো ৭ দিন। কই আমরা তো আত্নহত্না করি নাই। বরং মানুষ হয়েছি। আজ প্রতিটা স্টুডেন্ট এ+ পায়, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যদি ঠিক ভাবে খাতা দেখা হয় তাহলে ৯৫% স্টুডেন্টদের ৩৩ মার্ক পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এসব স্টুডেন্টদের কাছ থেকে আমরা ভবিষ্যতে কি বা আশা করতে পারি?

বলতে পারেন, বিদেশের শিক্ষাব্যস্থার কথা, সেক্ষেত্রে আমি বলব, আমরা বাঙ্গালী, লজ্জা নামক শব্দটা আমরা শিখি না। আমরা ভালো কথা শুনি না, ভালো আচারনের মূল্য দিতে জানি না। তাহলে বিদেশের সাথে এ দেশের তুলনা করবেন কিভাবে? এ দেশে সম্ভব না। সব কিছু আমাদের রক্তে মিশে গেছে।

এস এস সি পরীক্ষা চলছে। আর কিছুদিনের ভিতরই প্রকাশ হবে SSC Exam Result। এবারের রেজাল্ট নিয়ে আমি খুব চিন্তিত। এবছর এ+ এর হার খুবই কম হবে। কারন এবারতো তারা আগেভাগে প্রশ্ন পায়নি। শুনেছি দু এক জায়গায় প্রশ্ন ফাস হয়েছে তবে আমি বিষয়টা নিশ্চিত নয়।

যাই হোক, হাতে সময় আছে আরো দুই মাস, এই দুই মাস একটু খোঁজ খবর নিয়েন, মাঝে মাজে কলেজে এসে খোঁজ নেন। শুধুমাত্র শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়েই খালাস হয়ে যাবেন, এমনটা ভাবাও এখন ঠিক নয়।

এরই মধ্যে আমার ভাগ্নে চলে এলো, হাতের কাগজে কিছু একটা লিখেছে। এক নজর দেখে মনে হলো, অফিসিয়াল্লি কোন কিছু লিখতে লেখার ভিতর যেমন পরিচ্ছন্নতা থাকতে হয় সেটা সেই কাগজে ছিলো না।

এবার স্যারের দৃষ্টি আমার ভাগ্নের দিকে। শোনো বাবা, তোমার টেষ্টের রেজাল্ট দেখলাম, খুব একটা ভালো না। ইতিমধ্যে HSC Routine 2019 প্রকাশ হয়েছে। হাতে সময় আছে এখনো দুই মাস। তোমার ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। নিয়ম করে স্যাররা যেভাবে বলে সেভাবে পড়াশুনা শুরু করে দেও। শুধু এ+ পেয়ে পাশ করলেই হবেনা। মানুষ হতে হবে বাবা। আজ চারিদিকে হাজার হাজার এ+ ওলা মেধাবী ছাত্রছাত্রী দেখি কিন্তু মানুষ দেখতে পাই না। ওরা যে আজ খুব বিরল।

লাইটের আলোতে স্যারের চোখের কোনে জল চক চক করছিলো, একটু সুযোগ পেলেই হয়তো গড়িয়ে পড়ে যাবে। চোখে মুখে যেন ভিষন জেদ। যদি ক্ষমতা থাকতে তাহলে সব লন্ডভন্ড করে দিতো। ওরা কাদবেনাইবা কেন, ওরা যে ছিলো মানুষ গড়ার কারিগর অথচ আজ ওরা নিয়মের জালে বন্দি। হয়তো একদিন আবারো জন্ম নেবে মানুষ, হয়তো সব বদলাবে, মানুষ গড়ার কারিগররা স্বাধীন ভাবে আবারো গড়ে তুলবে মানুষ। আবারো হয়তো জন্ম নেবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সহ নানা পেশার মানুষ। কিন্তু বিবেকের কাছে প্রশ্ন, কবে আসবে সেদিন? নাকি এভাবেই চলবে বাকি জীবন?

লেখাছি এর আগে একটি ব্লগে প্রকাশ করেছিলাম।

Level 2

আমি জোবায়ের রহমান। Founder, Jobayer Academy, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 46 টি টিউন ও 28 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 4 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস